আশা
গ্রামবাংলার প্রত্যন্ত গ্রামের একটি পরিবারে জন্ম আশার। বাবা মায়ের অনেক বছরের তপস্যার পরে এই কন্যা সন্তানের জন্ম দত্ত বাড়িতে। বাবা মায়ের অনেক প্রতীক্ষার পরে এই কন্যা সন্তানের জন্ম হয়েছিল দত্ত পরিবারে, তাই বাবা মেয়ের নাম রেখেছিলেন আশা। বাবা রমেন দত্ত খুব যত্নে মেয়েকে বড়ো করে তোলেন। বাবা স্কুলের শিক্ষক এবং মা গৃহবাসী।
বাবা মায়ের ছত্রছায়ায় স্নেহ ও মমতায় বড়ো হয়ে ওঠে আশা।বিদ্যালয়ের পড়াশোনা শেষ করে বাবার ইচ্ছায় কলেজে ইংরেজি বিষয় নিয়ে কলেজে ভর্তি হয় আশা। যেকোনো বিষয় নিয়ে লেখার প্রতি খুবই আগ্রহ ছিল তার। কখনো কোনো অন্যায় দেখলে তার লেখায় ফুটিয়ে তুলতো। মেয়েদের এই একঘেঁয়ে জীবন যেমন- বিয়ে,সংসার-বিয়ের আগে বাবার অধীনে এবং বিয়ের পরে স্বামীর অধীনে থাকা কখনোই পছন্দ ছিল না তার।
আশা সবসময় চাইত নিজে কিছু করতে নিজের পায়ে দাঁড়াতে। দেখতে দেখতেই আশা ইংরেজি বিষয়ে মাস্টার ডিগ্রি শেষ করে ফেলে। তারপর বাবা মায়ের যা চিন্তা থাকে সেটা হলো মেয়ের বিবাহ, আশার ক্ষেত্রে ও তার ব্যাতিক্রম ঘটেনি। মা বলেন,”আশার এই বছরে ২৪ বছর পূর্ণ হবে,কিছু ভাবলে ওর বিয়ের ব্যাপারে”।
বাবা বলেন,”আমার মনে হয় ওর বিয়ের ব্যাপারে ওর মতামত নিয়ে নেওয়া আগে প্রয়োজন আমাদের”। মা বলেন,”তুমি কি যে বলো, আশা কি আজ অবধি আমাদের কথা অমান্য করেছে যে আজ করবে”।
বাবা বলেন,”সে তুমি ঠিকই বলেছ, তাহলে আমার পরিচিত অমিত মুখার্জীর ছেলে রাহুল খুবই ভালো ছেলে, High School -এ Math এর Teacher ওর সাথে আমাদের আশা কে ভালোই মানাবে। আর আমি রাহুল কে খুব ভালো ভাবেই চিনি খুব ভালো ছেলে। তুমি যদি বলো আমি অমিত বাবুর সাথে একবার কথা বলবো এবং ওনাদের আমাদের বাড়িতে এসে আশা কে দেখে যাওয়ার প্রস্তাব দেব”। মা বলেন,”হ্যাঁ, তুমি তাই করো”।
রমেন বাবু আশা কে বলেন,”মা তোকে দেখতে কাল অমিত বাবুর ছেলে রাহুল ও তার পরিবার আসছে। রাহুল খুবই ভালো ছেলে। তোকে খুব সুখে রাখবে।
আশা: কিন্তু বাবা আমি আগে নিজে কিছু করতে চাই। নিজের পায়ে দাঁড়াতে চাই তার পর না হয় বিয়ে দিও।
রমেন বাবু: তুই কোনো চিন্তা করিস না মা, তোকে ওরা পড়াবে বিয়ের পরে। তুই পড়তে চাইলে পড়তে পারবি। আশা কিছুটা বিভ্রান্ত মনে করলেও বাবার মুখের ওপর তার মনের ভিতরের অনুভূতি গুলো ফুটিয়ে বলতে পারেনি।
হয়তো এই না বলতে পারা কথা গুলো ওকে অনেকটা কষ্ট দিয়ে ছিল। কিন্তু সে কাউকে বলতে পারেনি। হয়তো সে চাইছিল সেদিন জোরে কাঁদতে কারণ কান্নার মাধ্যমেই তার মনের ভিতরের সব কষ্টগুলো বেরিয়ে যেতে পারতো।
প্রকৃতির নিয়মে সমাজের প্রথা মেনেই সব মেয়ের মতোই আশা কে ও বাবার ছেড়ে শ্বশুর বাড়িতে যেতে হল। বিয়ের কিছুদিন খুব ভালোই কেটে যায় আশার শ্বশুর বাড়িতে। সবার সব কথা মেনে চলে আশা। শাশুড়ি বলেন,”মা, সত্যি তোমার বাবা মা তোমাকে সর্বিক শিক্ষা দিয়েছেন। এত শান্ত আর বাধ্য মেয়ে আজকের দিনে আমি তো কল্পনাই করতে পারি না।” রাহুল ও খুব খুশি।
শ্বশুর বাড়ির সব কাজ খুব ভালই ভাবেই সম্পাদন করে আশা।এই ভাবেই কিছু দিন কেটে যায়। তারপর হটাৎ একদিন মন খুলে কিছু বলার ইচ্ছে হল,আর সে তার শাশুড়ি মাকে বলে,”মা,আপনি যদি অনুমতি দেন একটা কথা বলবো মা”। শাশুড়ি সেলাই করতে করতে বলেন,”মা, এতো অস্বস্তি বোধ করছো কেন? বলো কী বলতে চাও”।
আশা নীচের দিকে মাথা নত করে বলে,”মা আমি চাকরি করতে চাই”।
শাশুড়ি সেলাই এর মেশিনটা বন্ধ করে একদৃষ্টিতে বড়ো বড়ো চোখ করে আশার দিকে তাকিয়ে বলেন,”কী বলছো বৌমা’ মুখার্জী পরিবারের বউরা চাকরি করতে যায় না। একথা তোমার প্রথমে বোঝা উচিত ছিল। এই ঘরের আমি সরকার। আর আমার কথাই শেষ কথা। আমি এই বাড়ির সরকার আর তুমি এই বাড়িতে যে সারাদিন কাজ করছো ভেবে নাও এটাই তোমার সরকারি চাকরি,’ এই কথা যেন আর কখনো না শুনি”।
এক লহমায় আশার সব স্বপ্ন ভেঙ্গে যায়। বাবার সেই শ্বশুর বাড়িতে পড়ানোর কথা ও মিথ্যে প্রত্যাশা বলে মনে হয়। দিনের পর দিন তিল তিল করে মনের মধ্যে শেষ হয়ে যেতে থাকে মেয়ে টা এই ভেবে যে পরের আশায় কীভাবে সারাটা জীবন কাটাবে সে। ভেবেছিল নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে নিজে স্বাধীনভাবে বাঁচবে কিন্তু তা আর হল না।নিজেকে দিশেহারা এক পথিক হিসেবে খুঁজে পায় নিজেকে।
ভেবেছিল নিজের স্বামী হয়তো তার স্বপ্নকে বুঝবে তাকে সমর্থন করবে কিন্তু না তা আর হল না তিনি ও সেই মায়ের অনুসরণকারী। তার মতে, কী দরকার মেয়েদের বাড়ির বাইরে বেরিয়ে চাকরি করা আর ঘরের চার দেওয়াল এর মধ্যেই অনেক বেশি নিরাপদ”। শেষ যে টুকু আশা ছিল তার ও সমাপ্তি ঘটেছিল। ধীরে ধীরে যেনো আশা মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যেতে থাকে।
এবং সে এই দুঃখে ধীরে ধীরে ভেঙে পড়তে থাকে যে কেউ তাকে বোঝে না।শেষ পর্যন্ত এত মানসিক যন্ত্রনা সহ্য করতে না পেরে আশা আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। এই ভাবেই একটা মেয়ে শেষ হয়ে যায়। হয়তো এই আশার মতোই আমাদের দেশের হাজার হাজার মেয়ে এই অধিকার না পাওয়ার জন্য লড়াই করে যাচ্ছে অপ্রাণভাবে।
হয়তো একদিন ওরা সাফল্য লাভ করবেই।